আকাশের নিস্তব্ধতা আমার ভালো লাগে। সব জায়গাতেই দেখেছি একাকিত্বের উপমা হিসাবে সুবিশাল এই আকাশকেই পেশ করা হয়। নতুন নতুন রঙে। অথচ আজ এই আকাশ নিয়েই মহা প্রলয়। আকাশের কোনখানে চাঁদ ঘাপটি মেরেছে তা নিয়েই হল্লা। এতো হল্লার মাঝে কি আর আকাশের নিস্তব্ধতা বজায় থাকে?
ছোট্টবেলায় আমিও মেতে উঠতাম। রাতের বেলায় ছাঁদে উঠে ছোট্ট ছোট্ট চোখ মেলে তাকাতাম। আকাশে চাঁদ খুঁজতাম। পেয়ে গেলেই মহা-আনন্দে লাফিয়ে উঠতাম। বাসায় মশলাদি প্রস্তুত করার মহা-যজ্ঞ শুরু হতো। কুঁচি-পিয়াজের তীব্র ঝাঁজের ভয়ে আপুরা রুমের দরজা বন্ধ করে মেহেদী লাগাতো। মেহেদী শুকাতেই পাঁচ কড়ি খেলায় মেতে উঠতো। মা-চাচীরা গল্পে মাততো। চারিদিকে হৈ-হুল্লোড় , কাল যে ঈদ!
ঈদের সকালে চোখ কচলাতে কচলাতে গোসল, নতুন জামা পড়ে আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করে আব্বুর পায়ে পায়ে ঈদগাহে যেতাম।
বেলা হতেই কাকারা ভীর জমাতো। চাচাতো ভাই-বোনদের কল্লোলে বাড়ি মাথায় ওঠারই যোগাড় হতো। তখন বেশ বিরক্ত হতাম। নিষ্পাপ মাথায় ভাবতাম ‘এতো ভীর! উফ..!
আবার সকলে বিদায় নিলে মনের অজান্তেই মন খারাপ হয়ে যেত। হৈ-হুল্লোড় যে শেষ!
অথচ এখন..!
চাঁদ দেখতে মন চায় না। আগ্রহ অনুভব করি না। দেখেই বা কি হবে ছোট্টবেলার সেই সব অনুভূতি তো কাজ করে না। বাসা থেকে পিয়াজের ঝাঁজালো ঝাঁজও আসে না। আপুরাও দরজা বন্ধ করে না। তারা তো থাকেই না। চাচীদের সন্তান বড় হয়েছে। সংসারধর্ম প্যাচিয়ে উঠেছে। তারাও আর এমুখো হয় না। খা-খা করতে থাকা বাড়ি খা-খা করতেই থাকে।
মাঝেমধ্যে মনে হয় উনিশ শতকের প্রথমার্ধের একান্নবর্তী পরিবারগুলোই বুঝি বেশ সুন্দর ছিলো। একাকিত্বের কোনো নিশানা নেই। চারিদিকেই কেবল লোক আর লোক। কেবলই বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলে ওঠার সুযোগ থাকবে ‘উফ! চারিদিকে এতো লোক কেন! একাকি থাকারও কি জায়গা নেই!’
বাড়ি খা-খা করার থেকে এই বিরক্তকর অনুভূতিই হয়ত বেশী ভালো।
শতাব্দী বদলেছে। মানুষও বদলেছে। তারা এখন আর একই হাঁড়িতে খেতে পারে না। হয়ত সম্ভবই নয়। বিশ্বাসঘাতকতা, আত্মীয়তার বন্ধন লুপ্ত করার হীনমন্যতা যেন রন্ধে রন্ধে প্রবেশ করেছে। এর থেকে নিস্তার নেই। নেই অকৃতজ্ঞতার পটভূমি বদলাবার কোনো উপায়। যদি থাকতো তবে হয়ত এই পৃথিবীটা সুন্দর হতো। গল্পের মত সাজানো-গোছানো পরিবার হতো। যাক গে! আমিও তো এই শতাব্দীরই সন্তান!
লেখক: গল্পকার