যথাসময়ে নামাজ আদায় মুমিনের প্রধান দায়িত্ব
حَدَّثَنَا أَبُو عَمَّارٍ الْحُسَيْنُ بْنُ حُرَيْثٍ، حَدَّثَنَا الْفَضْلُ بْن مُوسَى، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ الْعُمَرِيِّ، عَنِ الْقَاسِمِ بْنِ غَنَّامٍ، عَنْ عَمَّتِهِ أُمِّ فَرْوَةَ، وَكَانَتْ، مِمَّنْ بَايَعَتِ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَتْ سُئِلَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَىُّ الأَعْمَالِ أَفْضَلُ قَالَ “ الصَّلاَةُ لأَوَّلِ وَقْتِهَا
সরল অনুবাদ-
হজরত উম্মু ফরওয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা (যিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বায়আত হয়েছিলেন) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল সবচেয়ে মর্যাদাবান আমল কোনটি? তিনি বলেছিলেন ওয়াক্তের শুরুতে নামাজ আদায় করা।
সূত্র-সহিহ আবু দাউদ ৪৫২, মিশকাত ৬০৭, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ১৭০ [আল মাদানী প্রকাশনী]
•বর্ণনাকারী-পরিচিতি•
উম্মু ফারওয়াহ বিনতে আল-কাসিম (আরবি: أم فروة بنت القاسم) রাদিয়াল্লাহু আনহা! তিনি উম্মু ফারওয়াহ নামে প্রসিদ্ধ হলেও তার মূল নাম ফাতিমাহ। যিনি ছিলেন মুহাম্মাদ আল বাকির এর স্ত্রী, এবং ইমাম জাফার সাদিকের মুহতারামা মাতা। তাঁর পিতা বিখ্যাত তাবি’ঈ আলিম (ধর্ম তাত্ত্বিক) কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবি বকর এবং পিতামহ বিখ্যাত রাজনীতিবিদ সাহাবি মুহাম্মাদ ইবনে আবি বকর রাদিয়াল্লাহ আনহু। উম্মু ফারওয়াহ এর আরেক পুত্রের নাম আব্দুল্লাহ।
জ্ঞান সাধনা-
ইসলামী ইতিহাসে তার অগাধ জ্ঞানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি হাদিস বর্ণনাকারী হিসেবেও হাদিস শাস্ত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।যার ফলে তিনি তার সময়ের শ্রেষ্ঠ নারীদের অন্যতম ছিলেন।
জন্ম ও ইন্তেকাল-
তার জন্ম ও ইন্তেকালের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তিনি সমাহিত আছেন জান্নাতুল বাকিতে । তার স্বামী মুহাম্মদ আল বাকিরের পার্শ্ববর্তী কবরে।
শাব্দিক বিশ্লেষণ :
صلاة (সালাত) আরবি শব্দ, বহুবচনে ٱلصَّلَوَات (সালাওয়াত) ।”সালাত”-এর আভিধানিক বা শাব্দিক অর্থ: দোয়া, রহমত, নত হওয়া, অনুসরণ করা, উপাসনা, ক্ষমা প্রার্থনা ইত্যাদি বুঝায় । আজানের ভাষ্য অনুসারে সালাতের অপর নাম-
১.الفلاح (ফালাহ) অর্থাৎ সাফল্য।(হাইয়া আলাল ফালাহ অর্থাৎ সাফল্যের জন্য এসো) এবং ২. خير (খয়র) অর্থাৎ উত্তম। (আস্ সালাতু খয়রুম মিনান্নাউম অর্থাৎ ঘুম থেকে নামাজ উত্তম)।
নামায : সালাতের আঞ্চলিক নাম নামায শব্দটি ফার্সি: نماز শব্দ থেকে উদ্ভূত।আরবী صلاة (সালাত) শব্দের সমার্থকরূপে نماز (নামায/নামাজ) শব্দটি একাধারে উপমহাদেশীয় অঞ্চলের বাংলাদেশে বাংলা ভাষায়, ভারতে হিন্দি এবং পাকিস্তানে উর্দু ভাষায় একীভূত এবং বহুল প্রচলিত।
ইসলামী শারীয়তের পরিভাষায় সালাত বা নামায-
ইসলামী পরিভাষায় শারিয়াহ নির্ধারিত তথা মহান আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক পবিত্র কুরআনে নির্দেশিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আমলকৃত কতিপয় আহকাম-আরকান সহকারে বিশেষ বিশেষ ওয়াক্ত বা সময়কালে আদায়কৃত বিশেষ ইবাদাত-কে সালাত বা নামায বলে।
নামাযের প্রকারভেদ-
১.ফরয ২. ওয়াজিব ৩. সুন্নাত ৪. নফল।
ফরযের প্রকারভেদ-
১.ফরজে আ’ঈন এবং ২. ফরজে কিফায়া
১.ফরজে আ’ঈন: প্রত্যেক ঈমানদার প্রাপ্ত বয়স্ক হুঁশ-জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির উপর ৫ ওয়াক্তে ফরয নামায আদায় করা ফরযে আ’ঈন (অবশ্যই পালনীয়)। যেমন: ফযরের ২ রাকায়াত ফরয, যোহরের ৪ রাকায়াত ফরয, আসরের ৪ রাকায়াত ফরয মাগরিবের ৩ রাকায়াত ফরয এবং ঈশার ৪ রাকায়াত ফরয ফরযে আঈন।
২. ফরজে কিফায়া:জানাযার নামাযে অংশ নেয়া ফরযে কিফায়া অর্থাৎ সমাজের পক্ষ হতে কেউ একজন হলেও অংশ গ্রহণ করলে যে ফরয আদায় হয়ে যায় তাকে ফরযে কিফায়া বলে।
সুন্নাতের প্রকারভেদ-
১. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা ২. সুন্নাতে জায়েদা
১. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা: ফযর,যোহর,মাগরিব,এশায় প্রত্যেক ফরয নামাযের আগে কিংবা পরের সুন্নাতকে বলা হয় সুন্নাতে মুয়াক্কাদা।
২. আসরের ফরযের পূর্বের সুন্নাত-কে সুন্নাতে জায়েদা বলা হয়। এই সুন্নাতে জায়েদা নামায সময় থাকলে মুকিমের জন্য পড়ে নেয়া উত্তম এবং সওয়াব।
প্রত্যেক বালেগ মুমিন-মুসলিমের জন্য দিনে এবং রাত্রে ২৪ ঘন্টায় ৫ (পাঁচ) ওয়াক্তে ৫ (পাঁচ) বার সালাত বা নামায আদায় করা ফরজে আইন। যথাঃ ১.ফজর ২.যোহর ৩. আসর ৪. মাগরিব ৫. ইশা।
হাদীস বিশ্লেষণ :
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম থেকে বর্ণিত হাদিস এই নির্দেশ করে যে, প্রতিটি মুমিনের জন্য প্রধান ও প্রথম কাজ হলো নামাজ। জীবনের বাস্তবতায় নানান ব্যস্ততা ও দায়িত্বের মাঝেও নামাজ যথাসময়ে আদায় করা। এই ব্যাপারে অন্যান্য হাদীসেও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
رِيْرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ فَنَظَرَ إِلَى الْقَمَرِ لَيْلَةً يَعْنِى الْبَدْرَ فَقَالَ إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ كَمَا تَرَوْنَ هَذَا الْقَمَرَ لَا تُضَامُّوْنَ فِىْ رُؤْيَتِهِ فَإِنْ اسْتَطَعْتُمْ أَنْ لَا تُغْلَبُوْا عَلَى صَلَاةٍ قَبْلٍَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوْبِهَا فَافْعَلُوْا ثُمَّ قَرَأَ وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ الْغُرُوْبِ.
জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা একদিন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি পূর্ণিমার রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, নিশ্চয়ই তোমরা তোমাদের রবকে অচিরেই দেখতে পাবে, যেভাবে তোমরা এই চাঁদকে দেখতে পাচ্ছ। তাঁকে দেখতে তোমাদের কোন কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে না। সুতরাং সূর্যোদয়ের পূর্বের সালাত ও সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বের সালাতের প্রতি যত্নশীল হও। অতঃপর তিনি এই আয়াত পড়েন, ‘সুতরাং তোমরা প্রতিপালকের প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ কর সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্য ডুবার পরে’।
فَضَالَةَ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ عَلَّمَنِىْ رَسُوْلُ اللهِ فَكَانَ فِيْمَا عَلَّمَنِىْ وَحَافِظْ عَلَى الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ قَالَ قُلْتُ إِنَّ هَذِهِ سَاعَاتٌ لِىْ فِيْهَا أَشْغَالٌ فَمُرْنِىْ بِأَمْرٍ جَامِعٍ إِذَا أَنَا فَعَلْتُهُ أَجْزَأَ عَنِّىْ فَقَالَ حَافِظْ عَلَى الْعَصْرَيْنِ وَمَا كَانَتْ مِنْ لُغَتِنَا فَقُلْتُ وَمَا الْعَصْرَانِ فَقَالَ صَلاَةٌ قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَصَلاَةٌ قَبْلَ غُرُوْبِهَا.
আব্দুল্লাহ ইবনু ফাযালা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন আমাকে কিছু বিষয় শিক্ষা দান করেন। তার মধ্যে রয়েছে, তুমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হও। আমি বললাম, এই সময়গুলো আমার জন্য খুব ব্যস্ততার। সুতরাং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাকে নির্দেশ দিন। যখন আমি তা পালন করব, তখন যেন আমার জন্য তা যথেষ্ট হয়। তিনি বললেন, তুমি দুই আসরকে যথাযথভাবে আদায় কর। এই ভাষা আমার জানা ছিল না। আমি বললাম, দুই আসর কী? তিনি বললেন- সূর্য উদয় ও অস্তের পূর্বের নামাজ অর্থাৎ ফজর ও আসর।
তাছাড়া নামাজ আদায়ের মাধ্যমে একজন মুমিন বান্দা সময়ানুবর্তিতা ও দায়ীত্বপরায়নতার শিক্ষা লাভ করে থাকেন। কেননা মুমিন বান্দা নিজের দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে যথা সময়ে নামাজ আদায় করতে পারে। নামাজ পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে, শৃঙ্খলার সাথে আদায় করতে হয়। এই ইবাদতটি শুধু মানুষকে শৃঙ্খলিত করে না, বরং স্রষ্টার সাথে বান্দার দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে তুলে। তাই নামাজ প্রতিষ্ঠা মানে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা।আর এটা প্রতিটি মুমিনের প্রধান দায়িত্ব।
•পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরযের ইতিহাস•
পবিত্র লাইলাতুল মিরাজের সময় মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাধ্যমে উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য হাদিয়া তথা উপহারস্বরূপ ৫০ ওয়াক্ত নামাজের বিধান নিয়ে দুনিয়াতে প্রত্যাবর্তনের সময় পথিমধ্যে হযরত মূসা আলাইহিমুস সালামের সাথে সাক্ষাতকালে তিনি নামাজের ওয়াক্তের পরিমাণ আল্লাহর কাছ থেকে কমিয়ে আনার জন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সুপারিশ করেন। সে মোতাবেক নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর দরবারে ফিরে গিয়ে ওয়াক্তের পরিমাণ কমানোর জন্য একাধিকবার আর্জি পেশ করলে তা মহান আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। ফলশ্রুতিতে, ওয়াক্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ (পাঁচ) । এবং আল্লাহ তা’আলা পাঁচ ওয়াক্তেই পঞ্চাশ ওয়াক্তের প্রতিদান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।(সূত্র: বুখারি, হাদিস নং: ৩৪৯, ৩৩৪২, ৩৮৮৭; )
আল্লাহ তায়ালা আমাকে সহ সকল দ্বীনি ভাইকে যথাসময়ে নামাজ আদায় করার তাওফীক দান করুন! আমীন!
দারস প্রস্তুতকারী-
সাঈদ আবরার
মুবাল্লিগ ও কওমি মাদরাসা সম্পাদক, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা মহানগর পূর্ব।