আতাউল্লাহ
ভাষা হলো বাগযন্ত্রের দ্বারা উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনির সাহায্যে মানুষের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। প্রখ্যাত ভাষাবিদ ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে পৃথিবীতে ২৭৯৬ টি ভাষা প্রচলিত আছে। ড. আ ফ ম খালিদ হোসেনের মতে ৬ হাজার ৫ শত ভাষা রয়েছে। পৃথিবীতে এতোগুলো ভাষা প্রচলিত রাখার মাঝেও আল্লাহ তায়ালার কুদরতের নিদর্শন ফুটে উঠে।
যা প্রস্ফুটিত হয় আল্লাহ তায়ালার এ কথা থেকে-
“আর তাঁর (কুদরতের) আরও একটি নিদর্শন হচ্ছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্যে রয়েছে বহু নিদর্শন।” সূরা রূম:২২।
তম্মধ্যে মর্যাদাগত দিক থেকে সবচেয়ে শীর্ষে রয়েছে আরবীভাষা। যার অলঙ্কার, মাধুর্য্য ও তাৎপর্য আমরা মানুষ মাত্রই মানতে বাধ্য। এ ভাষা মুসলমানদের কাছে সম্মানিতও। কেননা এ ভাষা-ই অবতীর্ণ হয়েছে তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ আল-কুরআন। এ ভাষা-ই কথা বলতেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ সা.।এ ভাষা ছাড়া সম্মানগত দিক থেকে বাকি সব ভাষা সমান।
ভাষা হলো ভালোবাসার মাধ্যম। ভাষা হলো চিন্তা ও চেতনার বাহন। ভাষা ভূষণে অলঙ্কারে, ধ্বনি-মাধুর্যে অনন্য। ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্যের অধিকারী একটি আলো। এতোশত ভাষার মাঝে নিজেকে রাণীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে যে ভাষা- তা হলো, আমাদের মায়ের ভাষা।
বাংলাভাষা। মাতৃভূমিকে ভালোবাসা যেমন আমাদের জন্য আবশ্যক ঠিক তেমনিভাবে মাতৃভাষাকেও রক্ষা করা আমাদের উপর অপরিহার্য। আর ভাষা রক্ষিত হয় তার সঠিক জ্ঞান ও সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে। জন্মগত সূত্রে মাতৃভাষার চর্চা ও উৎকর্ষ সাধনের প্রচেষ্টাগ্রহণ আমাদের জন্মগত দায়িত্ব ও নীতিগত কর্তব্য।
বাংলা ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। এ ভাষারই জের ধরে আমরা পেয়েছি বঙ্কিম, রবি ঠাকুর, নজরুল ও ফররুখের মত গুণীজন। যাদেরকে জাতি শুধু এ যুগেই নয় বরং যুগ যুগ ধরে নিজের বুকে জিইয়ে রাখবে। মনের মণিকোঠায় শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করবে।
কিন্তু এ ভাষার ভাব-মূর্তি এখন ধ্বংষের দোর-গোড়ায়। মজলুম ভাষার ফরিয়াদ শোনার মতো ব্যক্তি আজ হাতেগোণা। সবার কর্ণকুহরে পৌঁছাতে পারে না তার আর্তনাদ। নিথর হয়ে পরে আছে তার দেহখানি।
তার এই কঙ্কালসার দেহে রুহ ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন একঝাঁক সাহিত্যপ্রেমী। যাদের সৃজনশীল সাহিত্যে মাতৃভাষা ফিরে পাবে ম্লান হয়ে যাওয়া পুরোনো রূপ। ফিরে পাবে হারানো যৌবন।
সাহিত্য মানে ভাষার শিল্প বা সৌন্দর্য্য। সাহিত্য একটি আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিভা। সাহিত্যিক সৃষ্টি হয়, সাহিত্যিক কখনো বানানো যায় না। সাহিত্য ব্যক্তিকে চিন্তাশীল করে তোলে।
সাহিত্যের প্রাঞ্জল ভাষা, অলংকারপূর্ণ ব্যঞ্জনা ও সাবলীল অভিব্যক্তি শ্রোতার মনে গভীরে দাগ কাটে। চিন্তাধারার পুনঃজাগরণ সৃষ্টি করতে হলে একটা বলিষ্ঠ ও ন্যায়নিষ্ঠ সাহিত্যের প্রয়োজন ও গুরুত্ব এতোবেশি, যা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কোন জাতির শিক্ষা- সভ্যতা, সংস্কৃতি, তাদের নৈতিক মূল্যবোধ ও জিবন পদ্ধতি জানতে হলে বা পরবর্তী জাতির নিকট এগুলো পৌঁছে দিতে হলে অবশ্যই সাহিত্যের স্মরণাপন্ন হতে হয়। সাহিত্যচর্চা করতে করতে একসময় ব্যক্তির কলমের ভাষা ও মুখের ভাষা কাছাকাছি হয়ে যায়। তিনি যাই বলুন বা লিখুন না কেন তার মাঝে সাহিত্যরস পাওয়া যায়।
এই সাহিত্যরস আয়ত্ত্ব করাটাই একজন সাহিত্যানুশীলনকারীর আরাধ্য বিষয়।যে কোন বিষয়ের ক্ষেত্রে মনোজ্ঞ উপস্থাপনের জন্য সাহিত্যের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। সাহিত্য তার আপন মহিমায় যেনতেন বিষয়কেও শ্রোতার কাছে হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে পারে।
ভাষা ও সাহিত্য- একটি আরেকটির সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত । এ দুটোর মিশেলে গড়ে উঠে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। তাই ভাষাচর্চার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভাষাচর্চার প্রাচীর তৈরি করে তাতে সাহিত্যচর্চার ঢালাই দিতে হবে। তবেই তা একটি পূর্ণাঙ্গ ও মসৃণ দেয়ালে পরিণত হবে।