সাদ তাসনীম সাকী
সমস্ত পৃথিবী জুড়ে শুরু হয়েছে প্রলয়ঙ্করী ঝড়-তুফান। মানুষ তার জীবন বাঁচাতে হুশ-বেহুশ ছুটোছুটিতে ব্যস্ত। তাতারীদের শঙ্কায় শঙ্কিত বিশ্বের মানবসমাজ। একচ্ছত্র রাজত্ব যেন তাদেরই।
হ্যাঁ, এভাবেই তারা এগিয়ে চলছিল। একের পর এক দেশ জয় করে এগিয়ে যাচ্ছিল। সামনে বাধা হয়ে যে-ই আসে সেই পিষ্ট হয়। দলিত-মথিত হয় মাটি-মৃত্তিকার সাথে। তাদের বীর-বিক্রম দেখলে মনে হয় একেকজন দানব-দৈত্যের চেয়েও কম নয়।
এ জন্যই তো পরাজিত করা যায় না তাদের। পৃথিবীর কোনো শক্তিই তাদের থমকে দিতে পারে না। সব বাধা ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নরপশুদের এ তাতারি গুষ্ঠি।
তাদের বীরত্বে পৃথিবীময় প্রবাদ হয়ে গেছে,
“তাতারী পরাজিত–এ কথা বিশ্বাস করো না।” কে না জানে তাতারী গুষ্ঠির জয়জয়কার ইতিহাসের কথা। তাদের অমানুষী আর বর্বরতার গল্প কিয়ামতের বিভীষিকার মতো ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে যৌবন হারানো বৃদ্ধ পর্যন্ত সবার অন্তর কাঁপিয়ে দেয়। কিন্তু…
কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই বদলে গেল তাদের পরিচয়। নতুন পরিচয় নিয়ে আবির্ভাব হল বর্বর এ তাতারী গুষ্টি। বর্বর থেকে হয়ে গেল সভ্য পৃথিবীর অহংকার! মনুষ্য সমাজে চমক দেখিয়ে শ্রেষ্ঠতম সভ্য জাতিতে উত্তীর্ণ হল তারা।
পৃথিবী তখন হতবাক! অবাক বিস্ময়ে খুঁজে ফিরে তাদের বদলে যাওয়ার কাহিনী। কারণ, তারা অন্য সব ধর্ম ছেড়ে তখন মুসলিম নামে বিশ্বে খ্যাত। পুরো জাতি ইসলামের ছায়ায় নিজেকে সপে দিয়েছে। কেন? কী পেয়েছে শান্তির ছায়া এ ইসলামে?
রাজপুত তৈমুর তুঘলক। বয়স খুব বেশি নয়। বিশ/বাইশের ছোঁয়া ছাড়িয়ে যায়নি তখনও। শরীরের ধরণ-গঠন পালোয়ান রুস্তমের চেয়েও কম কীসে?! রাজকীয় শান নিয়ে ঘুরে-ফিরে পথেঘাটে। রাজ্যের সব সৈন্য-সামন্ত তাকে কুর্নিশ করে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করে। রাজ্যের ভাবী সম্রাট, ভবিষ্যৎ রাজমুকুটধারী।
তৈমুর তুঘলকের অন্যতম এক শখ ছিল “পশুশিকার”। নিত্যদিন শিকারে বের হত সেনাবহর নিয়ে। সম্রাট তার পুত্র ভাবী সম্রাটের জন্য নির্দিষ্ট বনাঞ্চল ঠিক করে
দিয়েছেন। সারা দেশময় নির্দেশ জারী হয়ে গেছে, রাজপুত্র তৈমুর তুঘলকের নির্দিষ্ট এরিয়ায় যেন কেউ শিকার করতে না যায়।
শিকার তো দূরে থাক, প্রবেশ পর্যন্ত নিষিদ্ধ। প্রবেশাধিকার শুধু রাজপুত্র তৈমুর তুঘলক আর তার দেহরক্ষী সেনাবহরের। অন্য কেউ এলে গর্দান বুকে লাশ হয়ে ফিরতে হবে।
এক দিনের ঘটনা। রাজপুত সৈন্য-সামন্তসহ শিকারে বের হয়েছেন। বনে শিকার খুঁজে বেড়াচ্ছেন। চুপচাপ ঘোড়া চালিয়ে পথ চলতে হয়। আওয়াজ করলে শিকার হারানোর ভয় আছে।
এমন সময়ে কেউ যদি পুরো বনে চিৎকার করে মাথায় তোলে কী হবে তার শাস্তি?! রাজপুত তাকে আস্ত রাখবেন কোন দায়ে? কিন্তু হল ঠিক তা-ই। শিকারে ব্যত্যয় ঘটল কোনো এক মানুষের গলার চিৎকারে। আচানক এমন আওয়াজে গর্জে উঠলেন রাজপুত তৈমুর তুঘলক।
হুকুম করলেন, “তল্লাশী চালাও। দেখো কে এ বনে প্রবেশ করেছে? তাকে এক্ষুণি উপস্থিত করো আমার সামনে। জ্যান্ত দেখতে চাই সে দুঃসাহসী অসভ্যকে।”
সৈন্য-সামন্তের কিছু লোক “জো হুকুম শাহজাদা” বলে ঘোড়া হাঁকিয়ে ছুটে গেল বনের গভীরে। মুহূর্ত কয়েক পর অপরাধী ছাড়া খালি হাতে ফিরে এলো। নতশিরে কুর্নিশ করে জানাল,
“মহামান্য শাহজাদা! ছোট্ট এক মুসলিম কাফেলা। তাদের ধর্মীয় রীতি পালনে আজান দিয়েছে। এখন নামাজ পড়বে। এটা তাদের স্রষ্টাকে পূজা করার এক প্রকার নিয়ম-বিধান।”
রাজপুত তৈমুর তুঘলক গর্জে উঠল। বলল, “বলেছি না গ্রেফতার করে নিয়ে আসতে? খালি হাতে ফিরলে কেন? এক্ষুনি সব ক-টাকে আমার সামনে উপস্থিত চাই।”
সৈন্যরা আবারও ফিরে গেল। কাফেলার সব সদস্যদের বন্দী করে নিয়ে এলো। সবার মনেই ভয়-শঙ্কা। তাতারীদের পশুত্ব সম্পর্কে জগৎ জুড়ে প্রবাদ আছে। তাই ভয়ে কুকড়ে আছে সবাই।
রাজপুত হুঙ্কার ছেড়ে জিজ্ঞেস করল,
“এখানে প্রবেশের সাহস পেলি কোথায় তোরা?” কেউ উত্তর দিল না। কাফেলার মান্য-গণ্যদের সবার মুখে তালা ঝুলেছে যেন। পিছন থেকে এক সদস্য এগিয়ে এলো। ভয়-ভীতি আর শঙ্কা ঝেড়ে নম্রকণ্ঠে উত্তর দিল,
“আমরা পরদেশী মুসাফির। এখানকার নিষিদ্ধতার ব্যাপারে আমাদের পূর্ব অবগতি ছিল না। ব্যবসার সফরে পথ চলছিলাম। মাঝপথে আমাদের নামাজের সময় হওয়ায় যাত্রা বিরতি করেছি। নামাজ শেষ হলেই আবার পথচলা শুরু করব।”
রাজপুতের পরবর্তী প্রশ্ন, “তোদের দেশ?”
“পারস্য।” এবার রাজপুতের চেহারায় ফুটে উঠল তাচ্ছিল্যের হাসি। বিদ্রুপ করে প্রশ্ন করল, “পারস্যের কোনো মানুষ উত্তম না রাস্তার সামান্য কুকুর?”
রাজপুত তৈমুর তুঘলক যার সাথে কথা বলছিলেন, তিনি ছিলেন শায়েখ জামালুদ্দিন। কাফেলায় থাকা একমাত্র আলেম। শান্ত ও গুরু গম্ভীরতাই তার বিশেষ শান-শওকত। কথা বলেন খুব অল্প। মানুষের মন জয় করে নেন সে অল্প কথার মাধুরিতেই।
যে কারো সাথে কথা বলেন, তার হৃদয়ে স্থান তৈরি করে নেন নিজের জন্য। এখানেও তা-ই করলেন। ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসির রেখা টেনে শান্ত ভঙ্গিতে জবাব দিলেন,
“যদি আমরা দীনদার না হতাম তাহলে কুকুরই উত্তম হত। যার কাছে দীন নেই সেই তো কুকুরের চেয়ে অধম।”
জবাবটি শুনে রাজপুত্রের রাগ-গোস্বা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। কপালে ফুটে উঠল বিস্ময়ের রেখা। তবে কোনো প্রশ্ন করেননি। দেহরক্ষীদের দিকে ফিরে নির্দেশ দিলেন, “এদের এখান থেকে নিয়ে যাও। শিকার করা শেষ হলে আমার সামনে উপস্থিত করবে।”
সেনারা হুকুম তামিল করল। রাজপুত্র তৈমুর তুঘলকের শিকার করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। ব্যস্ততায় ভুলেও গেল সব। তখন এক সেনা মনে করিয়ে দিল তাকে। তারপর জানতে চাইল তাদের উপস্থিত করা হবে কিনা? অনুমতি দেওয়া হলে শায়েখকে নিয়ে আসা হল।
তৈমুর তুঘলক শায়েখের কাছে জানতে চাইলেন দীন কী? শায়েখ ঈমানের পরিচয় তুলে ধরলেন। আল্লাহর একত্ব ও তার পরিচয়, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিরাতের সংক্ষিপ্ত কিছু কথা, আমাদের জীবনের আসল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, ইহকাল-পরকালের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ব্যক্ত করলেন তার কাছে। রাজপুত্র সব শুনে মুগ্ধ হলেন। ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী হলেন। তবে তৎক্ষণাৎ নয়, সময় নিয়ে। অবকাশের গ্রহণের পর।
রাজপুত্র তৈমুর তুঘলক বিনীতভাবে শায়েখকে বললেন, “আমি এ রাজ্যের ভাবী সম্রাট। রাজমুকুট ধারণ করব। পৈত্রিক সূত্রে এ সাম্রাজ্যের সম্রাট হব আমি, বাবার মৃত্যুর পর। তখন দীন কবুল করব।
কারণ, এখন ইসলাম গ্রহণ করলে রাজ্য-ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যাবে। প্রজারা বিরোধীতা করবে। একটু সময় দিলে তখন তারাও আমার প্রতি মুগ্ধ হবে, আমার আদেশ পালন করবে। সাথে সাথে দীনও কবুল করে নিবে।
তবে আপনার কাছে আমার করজোড় অনুরোধ থাকবে, আমার সিংহাসনে আরোহনের পর আপনি আমাদের এখানে আসবেন। আমাদের প্রাসাদে আপনার পদধূলি দিয়ে ধন্য করবেন।”
শায়েখ জামালুদ্দিন রাজপুত তৈমুর তুঘলকের সাথে আরো কথাবার্তা বলে বিদায় নিলেন। তার মন জয় করে সাথে করে নিয়ে ফিরলেন। তার বেশ কিছু দিন পরের কথা। শায়েখ তখন শয্যাশায়ী। মরণব্যাধিতে আক্রান্ত তিনি।
মৃত্যু তার ঘনিয়ে এসেছে। মহান মালিকের ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণছেন শায়েখ। তখনও তৈমুর তুঘলক সিংহাসনে বসতে পারেননি। তাই শায়েখ ভাবলেন নিজ পুত্র রশিদুদ্দিনকে বিষয়টি জানানো দরকার। তাকে শিয়রে ডেকে সব শোনালেন। ওসীয়ত করে বললেন,
“বাবা! আমার মৃত্যুর পর তুমি এ দায়িত্বটি পূর্ণ করবে। তৈমুরকে তার প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিবে। আর আমার সালামটাও তাকে পেশ করো।”
এরপর সবই ঘটে গেল। শায়েখ মারা গেলেন। তৈমুর রাজমুকুট ধারণ করলেন। যুবরাজ রাজায় পরিণত হলেন। তার সংবাদ শায়েখজাদা শায়েখ রশিদুদ্দিনের কাছেও পৌঁছল। ওসীয়ত অনুযায়ী তিনি ছোট্ট কাফেলাকে সঙ্গী করে রওনা হলেন তাতারী সম্প্রদায়ের রাজ্যের দিকে। পৌঁছে গেলেন অল্প সময়েই।
কিন্তু সমস্যা হল রাজপ্রাসাদে প্রবেশের ক্ষেত্রে। প্রহরীরা তাঁকে প্রবেশে বাধা দিল। কিছুতেই নব্যসম্রাট তৈমুর তুঘলকের কাছে তিনি পৌঁছাতে পারছিলেন না। এক প্রকার বাধ্য হয়েই ভিন্ন পন্হা অবলম্বন করলেন। ভেবেচিন্তে অন্য কোনো কৌশল খুঁজে বের করলেন।
রাজপ্রাসাদের অনতিদূরে তাবু স্থাপন করলেন শায়েখ রশিদুদ্দিন। থাকা শুরু করলেন রাত-দিনের সব সময়ে। নামাজের সময় হলে উচ্চকণ্ঠে আজান দেন। এমনভাবে আওয়াজ করেন যেন, রাজপ্রাসাদের দেওয়াল ভেদ করে সম্রাটের কান পর্যন্ত আওয়াজ পৌঁছয়। কিন্তু কাজ হয় না। কয়েক দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। ফলাফল শূন্য। তবে দীনের দায়ী বলে কথা! এত সহজে হাল ছাড়তে রাজী নন তিনি।
এক ভোরের স্মৃতিকথা। রাজা তৈমুরের ঘুম ভেঙ্গে গেল আচমকা। তিনি রেগেমেগে আগুন। প্রহরীকে জরুরী তলব করে নির্দেশ করলেন, “দেখো কে চিৎকার করছে? তার আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ঘুমুতে পারছি না। তাকে পাকড়াও করে নিয়ে আসবে এক্ষুনি।”
প্রহরী তৎক্ষণাৎ সেনাসহ উপস্থিত হল শায়েখের তাবুতে। গ্রেফতার করে নিয়ে এলো প্রাসাদে। তৈমুর দেখলেন গ্রেফতারকৃত মানুষটি নিতান্তই গরীব পোষাক পরিহিত একজন অসহায়। তাই ভিক্ষুক ভেবে স্বাভাবিক দয়ার্দ্র হয়ে কথা বলা শুরু করলেন। বললেন,
“তুমি এমন চিৎকার করছিলে কেন? কী চাই তোমার?” শায়েখ সম্মান বজায় রেখে জবাব দিলেন, “আমি আজান দিচ্ছিলাম। এটা আমাদের ধর্মীয় রীতি। ইবাদত বলা হয় তাকে।”
আজান শব্দটি শোনার সাথে সাথে সম্রাট তৈমুর তুঘলকের মনে পড়ে গেল শায়েখ জামালুদ্দিনের কথা। পরক্ষণে শায়েখ রশিদুদ্দিন নিজেই বলতে লাগলেন,
“আমি শায়েখ জামালুদ্দিনের ছেলে রশিদুদ্দিন। তিনি আমাকে আপনার কাছে আসতে বলেছিলেন।” “তিনি কোথায়? আসেননি?” “তিনি আপনার রাজমুকুট ধারণের আগেই এ দুনিয়া ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুর আগে আপনার জন্য সালাম রেখে গেছেন। আর আমাকে বলেছেন, আপনার কৃত ওয়াদার কথা মনে করিয়ে
দিতে।”
সম্রাট তৈমুর তুঘলকের মুখে ঝরে পড়ল আক্ষেপের শব্দ। “আহ! আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন! তিনি আজ দেখতে পারতেন আমি আমার ওয়াদা রক্ষা
করেছি। তার সাথে কৃত ওয়াদার কথা আমার মনে আছে। আমি ইসলাম গ্রহণে প্রস্তুত। আপনি আমাকে পুতঃপবিত্র করুন। আমাকে ধন্য করুন।”
তৈমুর তুঘলক ইসলাম নিজে ইসলাম গ্রহণ করলেন। নিজেই ওজীর-মন্ত্রীদের দাওয়াত দেওয়া শুরু করলেন। প্রজারা দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে শামিল হল। তাতারীদের সবাই ইসলাম গ্রহণে ধন্য হল।
বর্বর এক জাতি পরিণত হল পৃথিবীর।ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ বীরের জাতি। দিকে দিকে ইসলামকে ছড়িয়ে দিল। বিজয় হল নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনিত ধর্মের।
(তথ্যসূত্র: কিসাসুম মিনাত তারিখিল ইসালামি)