⏺ আতিকুল্লাহ খান
বললে ভুল হবে না, বর্তমান পৃথিবীতে সর্ববৃহৎ হচ্ছে শক্তি অর্থনৈতিক শক্তি।
মূলত এ অর্থনৈতিক শক্তিই নিয়ন্ত্রণ করছে আজকের রাজনৈতিক ও ভৌগলিক বিশ্বকে। আর এ অর্থনীতিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে বৈশ্বিক রাজনীতি। তাই সম্পদশালী হওয়ার প্রতিযোগিতায় পুরো বিশ্ব এখন সীমাহীন ব্যস্ত। ফলে সম্পদ আহরণ মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছে অন্তহীন অস্থিরতা আর চরম উন্মাদনা। আর সম্পদ সঞ্চয়ের এই অন্তহীন মনোভাব মানব সভ্যতার শুরু থেকেই ছিল এবং সম্পদ অর্জনের কলাকৌশল সম্পর্কে মানুষ বহু পূর্ব থেকেই গবেষণা করে আসছে। ফলশ্রুতীতে তারা আবিষ্কার করেছে বহু দর্শন ও উপকরণ।
আজ অবধি যতগুলো অর্থনৈতিক দর্শন পৃথিবীতে এসেছে,তার মধ্যে দুটি দর্শন উল্লেখযোগ্য। একটি ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা। অপরটি সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা। রাশিয়ার পতনের আগ পর্যন্ত দুটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই গোটা পৃথিবীকে দুটি দলে বিভক্ত করে রেখেছিল। তবে সমাজতন্ত্রের পতনের পর বর্তমানে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থাই পুরো বিশ্বে কলকাঠি ঘুরাচ্ছে। কিন্তু ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা মানুষকে ধনী ও দরিদ্র এ দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করে ফেলেছে। পুঁজিবাদী দর্শণের ফলে ধনিক শ্রেণী সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে আর দরিদ্র শ্রেণী সব রকম সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ অর্থব্যবস্থা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে বাধ্য করছে। কারণ ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা মানেই সম্পদ জমা করার এমন উপায় বা কৌশল, যেখানে অসহায়,দরিদ্র ও নিস্বের প্রতি কোন রকম ভ্রক্ষেপ করা হয়নি। সুতরাং এ ব্যবস্থা শুধু পুঞ্জিভূত করে, বিতরণ করে না। বলা যায়, সম্পদের সুষম বন্টনের কোন সুব্যবস্থা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, আল্লাহ কর্তৃক সৃজিত পৃথিবীর সম্পদরাজি পরিমিত, অতিরিক্ত নয়। সুতরাং কেউ ন্যায়-নিষ্ঠতা উপেক্ষা করে অতিরিক্ত সম্পদ জমা করলে নিশ্চয়ই সে অন্য কারো অংশ জমা করেছে।
এভাবে দরিদ্র শ্রেণীর সম্পদ ধনীরা বিভিন্ন কৌশলে জমা করে দরিদ্রদেরকে আরো দরিদ্রতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সর্বপরি ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ধনিক শ্রেণীর সম্পদ অর্জনের লিপ্সা এতটাই প্রবল যে, তারা দরিদ্রের সম্পদ চারদিক থেকে গুটিয়ে নিজেদের ভান্ডারে জমা করার একটি চমৎকার হাতিয়ার আবিষ্কার করেছে সেটা হচ্ছে, সুদ ব্যবস্থা।
এটি এমন একটি কৌশল যা দেখতে রংধনুর মত বর্ণিল, কিন্তু বাস্তবে প্রবল জলোচ্ছ্বাসের মতো ভয়ানক, ধ্বংসাত্মক। বাস্তবিকই এই অর্থব্যবস্থা জলোচ্ছ্বাসের খড় কুটোর মত গরীবের সম্পদ ধনীর ভান্ডারের মহাসাগরে নিয়ে ফেলে। বাস্তবে অর্থনৈতিক বিষয়গুলো এত জটিল ও সূক্ষ্ম যে, তা সাধারণ মানুষের জন্য মোটেও তা সহজবোধ্য নয় এবং বিষয়টির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবনের কথাও কখনো তাদের মাথায় আসেনি। আর তাই এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে, পৃথিবীর সুবিধাভোগী এক শ্রেণীর মানুষ। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে, সুদ ছাড়া ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড অসম্ভব এবং ব্যাংক ছাড়া আধুনিক অর্থনীতি কল্পনা করা যায় না। কিন্তু ইসলাম বলে অন্যকথা।
এখন আলোচনা করা যাক মানব সমাজে অর্থনৈতিক প্রভাব কতটুকু ও তার প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে ? আমরা জানি, বর্তমান বিশ্বে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে তার মধ্যে দুটি ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য।
এক, ধনতান্ত্রিক
দুই, সমাজতান্ত্রিক।
পৃথিবীতে যত রকম অর্থনৈতিক লেনদেন হচ্ছে, তা এই দুই ব্যবস্থার অধীনেই হচ্ছে। সকল অর্থনৈতিক দর্শন এ কথা অকপটে স্বীকার করে নিয়েছে যে, মানুষের অভাব ও চাহিদা মানবীয় উপকরণের তুলনায় বেশি। একারণেই অর্থনীতি শাস্ত্রকে ইংরেজিতে ইকোনমিক্স এবং আরবীতে ইকতিসাদ বলা হয়। অর্থাৎ সীমিত উপকরণগুলো এমনভাবে ব্যবহার করা, যাতে তা দ্বারা যথাসম্ভব বেশি প্রয়োজন মেটানো যায়। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রত্যেক অর্থনৈতিক দর্শনে কিছু মৌলিক সমস্যা থাকে, যা সমাধান না করে অর্থনীতি চলতে পারেনা। সাধারণভাবে বলা যায়,এ মৌলিক সমস্যা চারটি।
এক.
প্রয়োজনের অগ্রগণ্যতা নির্ধারণ। এর সারকথা হলো, মানুষের অভাব ও চাহিদা অগণিত। কিন্তু সে অনুপাতে উপকরণ সীমিত। আর সীমিত উপকরণ দ্বারা যেহেতু সকল অভাব ও চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই কিছু অভাব ও চাহিদাকে তুলনামূলকাভাবে অন্য কিছু প্রয়োজন থেকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিন্তু কোন অভাব কে অগ্রাধিকার দেবে আর কোন অভাব কে পিছনে রাখবে এটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, এক ব্যক্তির কাছে একশত টাকা আছে সেই টাকা দিয়ে চাল-ডাল কিনতে পারে, কাপড় কিনতে পারে। অথবা অন্য কোন জিনিসও কিনতে পারে। এই ইচ্ছাধীন কয়েকটি বস্তুর মধ্যে সে কোন কাজে টাকাগুলো ব্যয় করবে? এটাকে প্রয়োজনের অগ্রগণ্যতা নির্ধারণ বলা হয়।
দুই.
সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার । আমাদের কাছে উৎপাদনের উপকরণ অর্থাৎ মূলধন ও ভূমি আছে। এখন এগুলো কোন কাজে কী পরিমান ব্যবহার করব? আমাদের ভূমি আছে, এখন কতটুকু জমিতে ধান কিংবা গম আবাদ করব? আর কতটুকু জমিতে তরি-তরকারি চাষ করব? এই প্রশ্নের সমাধানকে অর্থনীতির পরিভাষায় সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার বলা হয়।
তিন.
আয় বন্টন বা উৎপাদিত দ্রব্যের বন্টন। অর্থাৎ জমি কিংবা কারখানা থেকে যা উৎপাদন হয় সেগুলো সমাজে কিভাবে বন্টন করা হবে? কিসের ভিত্তিতে বন্টন করা হবে? অর্থনীতির পরিভাষায় একে বলা হয় আয় বন্টন।
চার.
উন্নয়ন অর্থাৎ নিজের অর্থনৈতিক উৎপাদন গুলোকে কিভাবে উন্নত করা যায়? কীভাবে আগের তুলনায় আরো মানসম্মত হবে? যা দ্বারা সমাজের উন্নয়ন সম্ভব। অর্থনীতির পরিভাষায় তাকে উন্নয়ন বলা হয়।
প্রথমেই আমাদের জানতে হবে ধণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উপরোল্লিখিত চারটি মৌলিক সমস্যা কোন মূলনীতির ভিত্তিতে সমাধান করার দাবি করছে? সেগুলো সমাধান করার জন্য কী দর্শন পেশ করছে? ধণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বক্তব্য হল, এ চারটি সমস্যার সমাধানের একটি উপায় আছে। আর তা হলো, প্রত্যেক মানুষকে ব্যবসায়ীক ও শিল্পোৎপাদন তৎপরতার জন্য সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন ছেড়ে দিতে হবে। যে সর্বাধিক মুনাফা অর্জনের জন্য যে পদ্ধতি উপযুক্ত মনে করবে, সে সেটাই গ্রহণ করতে পারবে। এর দ্বারা অর্থনীতির উপর্যুক্ত চারটি সমস্যাই আপনা আপনি সমাধান হয়ে যাবে। কারণ প্রতিটি মানুষ যখন চিন্তা করবে আমি সর্বাধিক মুনাফা অর্জন করব, তখন প্রত্যেক ব্যক্তি সে কাজ করবে সমাজে যার প্রয়োজন রয়েছে।
উল্লেখ্য, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌলিক মূলনীতি হচ্ছে তিনটি :
এক. ব্যক্তি মালিকানা অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তির অধিকার থাকে সে তার মালিকানায় পণ্যদ্রব্য রাখতে পারে এবং উৎপাদনের উপকরণও রাখতে পারে। ব্যবহার্য সামগ্রী ও উৎপাদন সামগ্রী সব ধরনের বস্তু ব্যক্তিমালিকানায় থাকতে পারে।
দুই. ব্যক্তিগত মুনাফা অর্থাৎ উৎপাদন কর্মকাণ্ডে যে কাজ করে, সেটা প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের প্রেরণা।
তিন. সরকারি হস্তক্ষেপ মুক্ততা।সরকার ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করবে না। তারা যেভাবে কাজ করুক তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদান না করা সরকারের কর্তব্য। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের উপর অতিরিক্ত বিধি-নিষেধ আরোপ করা উচিত নয়।
আর সমাজতন্ত্র মূলত ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিবাদ হিসেবে অস্তিত্ব লাভ করেছে। তাদের দর্শন মতে, উৎপাদনের উপাদান অর্থাৎ ভূমি ও কারখানাকে মানুষের ব্যক্তিমালিকানায় স্বীকৃতি দেওয়াটাই সমস্যার জন্ম দিয়েছে। সকল উৎপাদন ব্যক্তিমালিকানা থেকে রাষ্ট্রের মালিকানায় থাকবে। তখন সরকার জানতে পারবে কার কাছে কী পরিমাণ উপাদান আছে? সমাজের প্রয়োজন গুলো কী কী? তার উপর ভিত্তি করে সরকার একটি পরিকল্পনা তৈরি করবে। এতে নির্ধারণ করা হবে সমাজের কোন প্রয়োজন গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া যায়।
সমাজতন্ত্রের মৌলিক মূলনীতি চারটি :
এক. সামষ্টিক মালিকানা উৎপাদনের উপাদান অর্থাৎ ভূমি এবং কারখানা ইত্যাদি ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকবে না বরং জাতীয় মালিকানায় থাকবে। আর তা পরিচালিত হবে সরকারী ব্যবস্থাপনায়
দুই. পরিকল্পনা। এর অর্থ সব ধরনের মৌলিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত সরকার নিজস্ব পরিকল্পনা অধীনে বাস্তবায়ন করবে। পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক প্রয়োজন এবং অর্থনৈতিক উপাদানের পরিমাণ ও সংখ্যা একত্র করবে। শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করবে।
তিন. সামষ্টিক স্বার্থ অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের দাবি হলো, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ব্যক্তির স্বার্থের অনুগামী। পরিকল্পনার মাধ্যমে মৌলিকভাবে স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া
চার. আয়ের সুষম বন্টন অর্থাৎ উৎপাদনের মাধ্যমে যে আয় হবে তা জনগণের মধ্যে সুষমভাবে বন্টিত হবে। ধনী দরিদ্রের মাঝে অতিরিক্ত ব্যবধান থাকবে না। উভয় শ্রেণীর মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকবে।
এ পর্যন্ত ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো। অল্প হলেও ধনতান্ত্রিক অর্থব্য বস্থার শিথিলতা আর সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার কঠোরতা সম্পর্কে জেনেছি। তাই দেখা গেছে, সমাজতন্ত্র ও ধণতন্ত্র ব্যবস্থার মধ্যে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে প্রচন্ড দ্বন্দ্ব চলে আসছে। দর্শনগত দিক থেকে উভয়ের মাঝে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা ও তর্ক-বিতর্ক চলে আসছে। রাজনৈতিক পর্যায়েও যুদ্ধাংদেহী ভাব চলমান রয়েছে। অবশ্য সমাজতন্ত্রের এতটুকু কথা বাস্তবে সঠিক ছিল যে, ব্যক্তিগত মুনাফার অর্জনের প্রেরণাকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তবে এতে জনকল্যাণের ধারণা হয় তো একেবারেই বাকি থাকে নি নয়তো অনেক পিছনে পড়ে গেছে।
কিন্তু তার যে সমাধান সমাজতন্ত্র প্রস্তাব করেছে সেটা ছিল অত্যন্ত চরমপন্থী চিন্তা। সমাজতন্ত্র ব্যক্তিকে এতটা চেপে ধরেছে যাতে ব্যক্তির নিজ স্বাধীনতাটুকুও রহিত হয়ে যায়। অপরদিকে ইসলাম অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এমন বিধি-নিষেধ ও দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছে যেগুলো বাস্তবায়িত হলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকবে।ব্যাংকিক কর্মকান্ডে কখনো সুদ-ঘোষের সুযোগ থাকবে না। ইসলামিক অর্থনৈতিক সম্পর্কে সময়-সুযোগ হলে পরবর্তী সংখ্যায় বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।